কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের তেতই গাঁও এলাকায় মণিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্স এর সামনে অনুষ্ঠিত হলো মনিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ‘থাবল চুম্বা’ উৎসব। এ বছর মনিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়রা ‘চেরাউবা’ বা নর্ববর্ষ উদযাপনের পাশাপাশি এক সাথে পালন করা হয় ঐতিহ্যবাহী ‘থাবল চুম্বা’ উৎসব। শনিবার ২ এপ্রিল সকাল থেকে শুরু হয়ে চলে মধ্য রাত পর্যন্ত পর্যন্ত।‘চেরাউবা’ বা নর্ববর্ষ বরণ উপলক্ষে সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রা ও জাতীয় সংগীত এর মাধ্যমে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে ছিলো চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা, দেবতার প্রতি আরাধনা (শরোয় খানংবা) সহ দিনভর ছিলো নানা আয়োজন। রাত সাড়ে ১০ দিকে ছিলো বিশেষ আর্কষণ থাবল চুম্বা নৃত্য। তাদের নিজেস্ব সংস্কৃতির রিতিনীতি অনুয়ায়ী তরুণ তরুণীদের পরিপাটি আর্কষণীয় পোশাক ছিল চোখ ধাঁধাঁনো। বৃত্তাকার বেষ্ঠনির নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে মন জুড়ানো ছিল আলোক সজ্জা। বৃত্তাকারের ভেতর আলো আধারের খেলায় এক অন্যরকম থাবল চুম্বা নৃত্য ও ধর্মীয় গান।
থেমে থেমে চলে তরুণ তরুণীর দীর্ঘদলবদ্ধ আকর্ষনীয় ও রোমাঞ্চকর সেই নৃত্য। অনুষ্ঠানের শেষ দিক মধ্যরাতে থাবল চুম্বা নৃত্যে উৎফুল্ল ছিলো তরুণ তরুণীরা। প্রাণবন্ত এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করেন কয়েক সহস্রাধিক দর্শক। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নানা বয়সের মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের লোকজনের সমাগমে সরগরম ছিলো বৃত্তাকার বেষ্ঠনি।
দু’টি প্রবেশ পথের একটি ছেলেদের। আর অন্যটি মেয়েদের। দর্শকদের জন্যও আছে নির্দিষ্ট সীমানা। প্যান্ডেলের মধ্যখানের গোল বৃত্তে বসা শিল্পী ৯৫ বছর বয়সী শম্ভুরতন সিংহ, সাথে দুই শিল্পী মঙাংলৈমা চনু, নির্মলাদেবীসহ তাদের বাদক দল। ওই শিল্পীরা থাবল চুম্বা গানের উপর দেশ বিদেশে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। বেশ দূর থেকে কানে ভাসে মাদকীয় সুরের গান ও বাদ্যযন্ত্রের সুর। ওই গান শোনে আবেগে মনের টানে মাঠে ছুটে আসেন মণীপুরী যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরীসহ নানা বয়সের লোকজন। কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী আর তরুণ তরুণীরা দলে দলে প্রবেশ করে বিশেষ ওই বৃত্তাকার প্যান্ডেলে। শিশুরাও ওই অনুষ্ঠানে নৃত্যকরে। চলে উচ্চ সুর আর বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নিজস্ব ভাষায় নানা আবেগময়ীতার গান। মণীপুরী নানা বয়সী ছেলে মেয়েরা ভাব বিনিময় করতে দল বেঁধে বাদ্যযন্ত্রের তালে নৃত্য করে উম্মোক্ত মঞ্চে।
সুনিপুণ মনোমুগ্ধকর এ নৃত্য নানা বয়সী দর্শকরা প্রাণভরে উপভোগ করেন। আর বয়স্কজনরা ছুটেন স্মৃতি রোমন্থনে। নিজস্ব রীতিনীতি মেনে নৃত্যের কয়েকটি পর্বে অনুষ্ঠান চলে গভীর রাত পর্যন্ত। শেষ পর্বে কড়া নিয়ম রীতিতে হাতের বন্ধন শক্ত করে ড্রাগন আকৃতিতে সৃষ্টিকর্তার নামে ওইসব আয়োজন ও নৃত্য উৎসর্গ করা হয় ব্যতিক্রমী নৃত্যের মাধ্যমে। নৃত্যে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী সানিয়া সিংহ, উদয় সিংহ ও লেইরিক সিংহ বলেন, দীর্ঘদিন পর এই উৎসব আয়োজন হচ্ছে সবাই একত্রিত হয়ে তা উপভোগ করছি এই আনন্দ অনুভূতি অন্যরকম। থাবল চুম্বা নৃত্য যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণীদের জীবনসঙ্গী খোঁজার এক ব্যতিক্রমী মাধ্যম। ভানুবিল মাঝের গাঁও কমিউনিটি বেইজ ট্যুরিজম এর প্রতিষ্ঠাতা নিরঞ্জন সিংহ রাজু ও শিক্ষক শান্ত কুমার সিংহ জানান কমলগঞ্জ উপজেলার ১৪ টি গ্রামের মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের লোকজন মিলে এবছর বর্ষবরণ ‘চৈরাউবা’ ও ‘থাবল চুম্বা’ উৎসবের আয়োজন করেন। কোভিড-১৯ এর কারণে গেল ২ বছর এরকম বড় পরিসরে অনুষ্ঠান করতে পারেন নি তারা। প্রায় সহস্রাধিক যুবক যুবতী ও তরণ তরুণীরা থাবল চুম্বা নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন। আর দর্শক ছিলেন প্রায় ৩ সহস্রাধিক। এটাই দেশের মধ্যে মণিপুরীদের সবচেয়ে বড় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।
Developed By Radwan Web Service