• সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৫ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :

শ্রদ্ধায় স্মৃতিচারণ: আমার বাবা – মো. খালিদ সাইফুল্লাহ্ রহমান

মো. খালিদ সাইফুল্লাহ্ রহমান / ১১৯ বার দেখা হয়েছে
প্রকাশিত : শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৪

মাহে রমাযান,১৪৪১ হিজরী, এপ্রিল ২০২০।

প্রতিবছরের ন্যায় এই বছরও রমাযান মাসে রোজা, তারাবিহ, তাহাজ্জুদ ও কুরআন তেলাওয়াতসহ প্রচুর পরিমাণে নফল ইবাদাত-বন্দেগীতে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে ব্যস্ত রাখেন আব্বা। সেই সাথে আমাদেরকেও রমাযান মাসের ফজিলতকে পূর্ণরূপে ব্যবহারের তালিম প্রদান করে ইবাদতে ব্যস্ত করে তুলেন। এভাবেই রহমত ও নাজাতের বিশদিন চলে যায়। আব্বার সাথে আমরাও রমাযানের পবিত্রতার আমেজে নিজেদের তৃপ্ত করি।

কিন্তু রমাযানের বিশটি রোজা সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে রাখার পর আব্বা একুশ রমাযানের সাহরী খেয়ে ফজরের সালাতে দাঁড়ালে বুকে ব্যথা অনুভব করেন। অতঃপর প্রচণ্ড বুকে ব্যথা নিয়ে ফজরের সালাত শেষ করে আমাদের কাছে ডেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে মৃত্যুর কথা বারবার স্মরণ করে বলেন- “আমি হয়তো আর বাঁচবো না। বুকে অস্বাভাবিক ব্যথা অনুভব করছি। আমি চলে গেলে অবুঝ সন্তানগুলোর কী হবে! আমার বড় চিন্তা হয়…।”

আমার পাথরের মতো সদা অবিচল থাকা আব্বার কাছ থেকে এমন কথা শুনে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাই, সব সাহস নিমিষেই হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। শৌর্যবীর্য, আভিজাত্য ও সাহসিকতার ত্যাজস্নিগ্ধ আব্বার বড়বড় রক্তিম চোখমুখের এমন ব্যথাতুর অভিব্যক্তি দেখে বুকের ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।

করোনাকালীন সময় হওয়ায় চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হলে আব্বা আবার বলেন- “সময় ফুরিয়ে এলে এমন অসামঞ্জস্যতাই ঘটে । আমার চাচার (মরহুম কেরামত আলী) মৃত্যুর সময়ও বিশেষ কারণবশত স্বাস্থ্য পরিসেবা বন্ধ থাকার কারণে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ হয়নি। উনার মতো আমার ভাগ্যেও হয়তো উন্নত চিকিৎসার সুযোগ হবে না।” যদিও প্রাথমিক চিকিৎসার পর পরের দু’রাত অনেকটা সুস্থভাবেই আমাদের সাথে কাটান আব্বা।

২.
২৩ রমাযান, ১৭ ই মে, দিন রবিবার।

অন্যান্য দিনের মতোই বারান্দায় বসে আমার বড়বোনের সাথে নবী-রাসূলদের (স:) জীবনী নিয়ে দীর্ঘসময় গল্প করে একটি সুন্দর সকাল কাটান আব্বা। এই আলোচনার ফাঁকেফাঁকে আব্বা আমার রুমের দিকেও সযত্নে খেয়াল রাখেন, যাতে আমার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। তাঁদের এমন আনন্দঘন সকাল দেখে বুঝার উপায়-ই ছিল না যে, একটু পরেই তাঁদের মধ্য থেকে একজন আমার কলিজার টুকরা আব্বা দুনিয়ার সফর শেষ করে মহান রবের সাক্ষাতে পাড়ি জমাবেন।। কারণ তখনও তিনি ছিলেন একদমই চিন্তামুক্ত, শান্ত-স্নিগ্ধ, আর অন্যসব মানুষের মতোই সুস্থ ও স্বাভাবিক। যাঁর মাঝে ছিল না কোন দৃশ্যমান শারীরিক বা মানসিক পেরেশানি বা আসন্ন মৃত্যুর প্রতি বিন্দুপরিমাণ ভয়।

এভাবে সকাল গড়িয়ে যোহরের ওয়াক্ত চলে এলে সবাই যোহরের সালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সালাত শেষে আব্বা যোহরের ওয়াক্তের শেষের দিকে কারো সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে ওয়াশরুমে যান, সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে পালঙ্কের পাশে রাখা চেয়ারে বসেন। একটু পানি পান করেন। অতঃপর তিনি বলেন- “অসুস্থতার জন্য আমি রোজা রাখতে পারছি না, ঠিকমতো সালাতও আদায় করতে পারছি না। তোমরা আল্লাহকে বেশিবেশি করো ডাকো।”

চেয়ারে বসে বসে আব্বা আমাদের উদ্দেশ্যে এমনসব নসিহা করেন। তখন আমার ছোট বোন আব্বার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে কোরআন তেলাওয়াত করে আব্বার বুকে ফুঁক দিতে থাকে। এসবের মাঝেই হঠাৎ আব্বার শরীরটা খারাপ হয়ে পড়লে ছোটবোন কালিমা পড়া শুরু করে। আব্বা কালেমা শুনে শুনে চেয়ারেই অজ্ঞান হয়ে যান। ততক্ষণে আমাদের চিৎকার শুনে পরিবার-পরিজন সবাই জড়ো হয়ে যান। আব্বাকে বিছানায় শুইয়ে মুখে ও মাথায় পানি ছিটানো হলে আব্বা বড়বড় চোখদুটি খুলেন, ধীরে ধীরে চতুর্দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিলেন এবং সবশেষে চোখ দুটি বন্ধ করে নিলেন। চোখের কোণে একটু পানি দেখা গেলো, ঠোঁটের কোণে হাঁসির চিহ্ন ফুটে উঠলো। অত:পর তিনি শান্ত হয়ে গেলেন। চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে গেলেন।

৩.
ছোটবেলায় আব্বা বিকেলে ঘুমিয়ে পড়লে রুমের কোণায় দাঁড়িয়ে থেকে আব্বার পেটের উঠানামা দেখে নিশ্চিত হতাম তিনি গভীর ঘুমে আছেন। আব্বার ঘুম ভেঙে গেলে শাস্তি পেতে হবে এমন ভয়ে পিনপতন নীরব থাকতাম। সেই আব্বা এই বিকেলে গভীর ঘুমে ডুবে আছেন, কিন্তু উনার পেট আজ উঠানামা করছে না। উনার পাশে দাঁড়িয়ে আব্বা! আব্বা! আব্বা! বলে শত চিৎকার করার পরও তিনি জেগে উঠছেন না, ঘুম ভাঙানোর কারণে আমাকে কোন শাস্তি দিচ্ছেন না।

উনার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কত কান্না করেছি, রাস্তার পথচারীরাও দেখে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু তিনি জাগেননি, নীরব ছিলেন, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন আর সে ঘুমেও ডুবে থাকবেন কিয়ামত অবধি। আমি জানি না আব্বার সাথে কখনও দেখা হবে কি না! তবে মহান মাবুদের দরবারে সবসময় দু’আ করি, কিয়ামতের ময়দানে লক্ষ-কোটি জনতার ভিড়ে আমার আব্বার সাথে আমাকে মোলাকত করে দিও। জান্নাতের এক এক কোণায় পিতা-পুত্রকে আলিঙ্গনের সুযোগ করে দিও।”

৪.
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের (রহ.) মতে, “কাউকে বিচার করতে হলে ওর জানাজার নামাজের উপস্থিতি দেখে বিচার করো।” রমাযান মাসে করোনা পরিস্থিতেও পুলিশের রক্তচক্ষু, লাঠিপেটা উপেক্ষা করে রাত ৯-১০ টায় আগত হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিই প্রমাণ করে, উনার বিদায় আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে কতটা নাড়া দিয়েছিল। তাই সমগ্র মৌলভীবাজার জেলার প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপও ছোট্ট জনপদ কমলগঞ্জের জনস্রোতকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছিল।

যদিও আব্বা কখনও ছিলেন না জনপ্রতিনিধি বা প্রার্থী বা কোন ক্ষমতাসীন দলের কর্মী বা নেতা। মানুষের পেছনে ব্যক্তিগতভাবে লক্ষ-কোটি টাকা ব্যায় করার মতোও ছিলেন না অজস্র সম্পদের মালিক। তবুও শুধুমাত্র একক ও স্বতন্ত্র পরিচয়ে ব্যক্তি ইমেজের দরুণ আপামর জনসাধারণের হৃদয়ের আসনে জায়গা করে নিয়েছিলেন।

আব্বা সম্পর্কে এককথায় মূল্যায়ন করতে হলে শুধু এটুকুই বলবো- “ধর্নাঢ্য ও অভিজাত পরিবারে জন্ম নেওয়া আমার পিতা সময়ের জোয়ার-ভাটার স্রোতে সবসময় সিক্ত হলেও রুচির মানের দিক থেকে মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ছিলেন সবচে’ সুরুচিশীল, আধুনিক, অভিজাত ও ধর্নাঢ্য মানুষ।”

৫.
আব্বা জীবিত থাকাকালে আমি লেখালেখি করার সুবাদে উনার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ থেকে উনাকে নিয়ে একবার লেখালেখি করি। আর সে কারণে তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন-” বাবা! আমাকে লেখালেখি করে উপস্থাপনের চেয়ে তোমাকে এমনভাবে তৈরি করো, যাতে সবার কাছে তোমার বাবা হিসেবে পরিচিত হতে পারি, আর এটাই হবে আমার কাছে সবচে’ আনন্দের ও গর্বের বিষয়।”

তাই আজও আমার কঠিন মুহূর্তে তিনি কখনও সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা আর টুপি পরে মুসাফির হয়ে স্বপ্নে পাশে এসে দাঁড়ান, মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দেন। যেনো তিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন উনার পূর্বের বক্তব্য-“আল্লাহ্ উত্তম পরিকল্পনাকারী। কাজেই হতাশ হইও না, নিরাশ হই না, ধৈর্য্য ধরো, তোমাদের কল্যাণ নিকটবর্তী ।”

মানুষের আসরে যখন কেউ আমার বাবার পরিচয় শুনে আমাকে বুকে জড়িয়ে নেয়, উনার প্রতি ভালোবাসা নিবেদন করে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে, সুন্দর বিষয়গুলোর স্মৃতিচারণ করে, তখন বিশ্বাস করুন আমার এই ছোট বুকটা গর্বে ফুলে উঠে, নিজেকে পৃথিবীর সবচে’ ভাগ্যবান সন্তান মনে হয়। কাজেই এমন একজন বাবার সন্তান হতে পেরে সবসময় গর্বিত। যিনি আমাকে এতো এতো দু’আ’য় না রাখলে, মানুষের প্রতি এতো এতো দরদী না হলে আমার চলার পথটা কখনই এতো মসৃণ হতো না। বাবা আজও বড্ড ভালোবাসি, সত্যিই প্রচণ্ড ভালোবাসি।

লিখেছেন: মো. খালিদ সাইফুল্লাহ্ রহমান
এলএলবি, (অনার্স), এলএলএম
হার্ডফোর্ডশায়ার ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য
কবি ও লেখক/পৃষ্ঠপোষক ও সমন্বয়ক
মো. বজলুর রহমান ফাউন্ডেশন


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো সংবাদ পড়ুন...
Developed By Radwan Web Service